নৌকার গ্রাম দাউদকান্দির চাঁপাতলী
দাউদকান্দি প্রতিনিধি: গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা ২৮৫। হিন্দুপ্রধান এই গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলোর মধ্যে ৩০টি জেলে, ২০টি নট্ট (নাচ-গান-অভিনয়সহ বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে জড়িত), ১৯টি নৌকার কারিগর, ১১টি কামার, আটটি শীল, সাতটি ধোপা পরিবার উল্লেখযোগ্য। এত বিচিত্র পেশার মানুষের বাস হলেও নৌকার কারিগর পরিবারগুলোর কারণে গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ‘নৌকাগ্রাম’ হিসেবে।
দাউদকান্দি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণের গ্রামটির নাম চাঁপাতলী। এই গ্রামের কারিগরদের বানানো নৌকাই হয়ে উঠেছে এখানকার অধিকাংশ মানুষের প্রাত্যহিক কাজের প্রধান বাহন।
আর দশটা গ্রামের মতো এই গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বহু আগে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। তবু মেঘনা, গোমতী, তিতাস, কালাডুমুর, খিরাই, ধনাগোদা ও কাঠালিয়া এই সপ্ত নদীবিধৌত দাউদকান্দিতে নৌকার ব্যাপক চাহিদা। মৎস্য প্রকল্প ও পুকুরগুলোতে মাছের খাবার দিতে, মাছ পরিবহনে, গরু-ছাগল পালনের যাবতীয় কাজে, মাছ ধরতে এবং বিভিন্ন খাল-বিল-জলাশয়ে চলাচলে নৌকার বিকল্প নেই।
এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা শুরু হলে চাঁপাতলী গ্রামে শুরু হয় নৌকা তৈরির উৎসব। এ বছরও তাই হয়েছে। বর্ষা মৌসুমের কিছুদিন আগে থেকে প্রতিটি ভোরে হাতুড়ি পেটানোর শব্দে ঘুম ভাঙছে এই গ্রামের মানুষের। সূর্য ওঠার আগেই কারিগরদের বাড়ির উঠোনে শুরু হয় নৌকা তৈরির মহাযজ্ঞ।
নৌকা তৈরির শুরু: চাঁপাতলীর নৌকা তৈরির ঐতিহ্য সুদীর্ঘকালের। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি সন্তোষ চক্রবর্তী (৬৫) ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সামছুল হক ভুঁইয়া (৭০) বলেন, প্রায় দেড় শ বছর আগে এই গ্রামে বলাই চন্দ্র সরকার নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর হাত ধরে এই গ্রামে নৌকা তৈরি শুরু হয়। ধীরে ধীরে গ্রামের অন্য পরিবারগুলো তাঁর কাছ থেকে এ কাজ রপ্ত করে। সেই থেকে বংশপরম্পরায় প্রাচীন হিন্দু পরিবারগুলোর হাতে এই শিল্প টিকে আছে।
নৌকা তৈরি: একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে দুজন লোকের সময় লাগে এক দিন। নৌকা তৈরিতে পরিবার-প্রধানকে সহযোগিতা করে পরিবারের নারী ও শিশুরা। ডিগলা, কোষা, পাতাইল্লাকোষাসহ হরেক নামের একেকটি নৌকা বানাতে খরচ হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এতে উঠতে পারে চার-পাঁচজন যাত্রী। বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। লাভের টাকায় নৌকার কারিগরেরা বছরের চার মাস সচ্ছলভাবে দিন কাটাতে পারেন। বছরের বাকি সময় কাঠের আসবাব তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা।
বাবার কাছ থেকে নৌকা বানানো শিখে নিয়েছেন কারিগর হরেন্দ্র চন্দ্র সরকারের ছেলে রাজীব সরকার, সুজন সরকার ও মিঠুন সরকার। তাঁরা বর্তমানে এই কাজ করে খুশি। আরেক কারিগর নির্মল সরকারের স্ত্রী অনিতা সরকার বলেন, ‘স্বামীর কাজে আমরা নিয়মিত সহযোগিতা করি’।
উপকরণ: নৌকা তৈরিতে লাগে জারইন, রেইনট্রি, কড়ই, চামুল, পোয়া ও উড়িগাব জাতীয় কাঠ এবং লোহালক্কড়। চাঁপাতলীর কারিগরেরা এই কাঠ সংগ্রহ করেন স্থানীয় গৌরীপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বরিশাল থেকে। সংগ্রহ করা কাঠ রোদে শুকিয়ে নৌকার ধরন অনুযায়ী কেটে টুকরো করা হয়। এরপর টুকরোগুলো মাটিতে বিছিয়ে নৌকা তৈরির কাজ শুরু হয়।
মৌসুম ও বাজার: ঐতিহ্যবাহী ইলয়টগঞ্জ ও গৌরীপুর বাজার ছাড়াও আশপাশের বাজারে নিয়ে নিজেদের তৈরি নৌকাগুলো বিক্রি করেন কারিগরেরা। অনেক ক্রেতা বাড়িতে এসে কিনে নিয়ে যান। আবার কেউ কারিগরের বাড়িতে গিয়ে নিজেদের চাহিদামতো অর্ডার দিয়ে যান।
গ্রামের ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন বলেন, এককালের অবহেলিত এই গ্রামের নাম এখন অনেকেরই মুখে মুখে। নৌকা দিয়ে চলাচলে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অন্যদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে গ্রামটি নৌকার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই চাঁপাতলী।
Comments
Post a Comment