কুমিল্লা বিভাগ চাই
শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ ও এককালের পথিকৃত কুমিল্লা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। কিন্তু এখানকার যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সাতচল্লিশের পর থেকে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় অবহেলায় আজ এর নাম হয়েছে চিরবঞ্চিত কুমিল্লা। এর অবস্থান প্রাক্তন চট্টগ্রাম বিভাগের কেন্দ্রস্থলে, অর্থাৎ সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে। অথচ ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ ঘোষণার সময় ফজলুল কাদের চৌধুরীর প্রভাবে কুমিল্লা বিভাগ না করে করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগ। ফলে সকল বিভাগীয় অধিদফতর স্থাপিত হয় চট্টগ্রামে। এতে সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিশাল জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে পড়ে চরম দুর্ভোগে। ঐ সময় দয়া করে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড ও ডি.আই.জি অফিস কুমিল্লায় দিয়ে এ এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীকে সান্ত¡¡না দেয়া হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় সিলেট ও চট্টগ্রামবাসী এরশাদ সাহেবের আমলে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা হাইকোর্ট এবং ৬২ সাল থেকে থাকা কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড ভাগ করে তাদের যার যার অংশ তারা নিয়ে যায়। সম্প্রতি ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতি গোপনে এক প্রশাসনিক আদেশে ডিআইজি (প্রিজন) অফিস স্থানান্তর করে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছে। কুমিল্লা বিভাগ না হওয়ায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। ঐ সময় কুমিল্লাবাসী দীর্ঘদিন রাজপথ-রেলপথে অবস্থান নিলেও রাতের অন্ধকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের গভীর অরণ্য হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। ১৯০৩ সালে ত্রিপুরা মহারাজার দানকৃত ৩৫৪ শতক ভূমির ওপর লর্ড ইলিয়ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ও বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ইলিয়ট টেকনিক্যাল কলেজ তথা লিয়াকত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট তথা শহীদ শামসুল হক টেকনিক্যাল কলেজটি কুমিল্লা এলজিইডি দফতর জাপান সরকার থেকে পাওয়া ১২কোটি টাকা অনুদানের অর্থ আত্মস্বার্থের জন্য তাদের নির্ধারিত স্থান টমছমব্রিজ-এর পরিবর্তে তৎকালীন অধ্যক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কলেজটিতে ছাত্র কম- এরূপ মিথ্যা অজুহাতে ৮৪ শতক জায়গা জোরপূর্বক দখল করে সেখানে বর্তমান এলজিইডি ভবন নির্মাণ করে। এদিকে গোপনে কলেজটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে কুমিল্লাবাসী আন্দোলনের পাশাপাশি আদালতে মামলা দায়ের করে জয়লাভ করলেও তা বর্তমান হাইকোর্টে বিচারাধীন ও ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। ইতোমধ্যে লুট হয়ে গেছে কলেজের শত বছরের অর্জিত সব সম্পদ ও যন্ত্রপাতি। এসব নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। ঐতিহাসিক কুমিল্লা টাউনহল মাঠের একাংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে এক বিশাল মার্কেট। বাখরাবাদ গ্যাস অফিস ভাগ করে কুমিল্লা থেকে এক ভাগ চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কুমিল্লায় হাজার হাজার একর খাস জমি একসনা লিজ নিয়ে দখল করে আছে কিছু লোক। অথচ জজ কোর্টে বিচারকদের এজলাস নেই, চেম্বার নেই, থাকার বাসাও নেই। সাত রাস্তার মাথা কান্দিরপাড়ে রিক্সার যানজটে সবাই অতিষ্ঠ। এখানে প্রয়োজন অন্তত: একটি ফ্লাইওভার। কুমিল্লা একটি মফস্বল শহর হতে পারে, কিন্তু নজরুল ও বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত এ জেলা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শৈলেশ রায়, উল্লাস কর দত্ত, শান্তি, সুনীতি, শচীন দেববর্মণ, সম্রাট শাহ সুজা, প্রফুল্ল নলিনী, অশোক নন্দী, ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, আব্দুল কদ্দুস মাখন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, মহামতি মহেশ ভট্টাচার্য্য, আরপি সাহা, মেজর গণি, আখতার হামিদ খান, বসন্ত মজুমদার, নবাব ফয়জুন্নেসা, নবাব মোশাররফ, হেম প্রভা, অজিত গুহ, কামিনী কুমার দত্ত প্রমুখদের। ’৬৯-এর ১৭ মার্চ গণঅভ্যুত্থানে কুমিল্লার লাকসামের জনগণ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা মিলে মেরে ফেলে ওসি সৈয়দ কলন্দর আলীসহ ৫ পুলিশ কর্মকর্তাকে এবং আহত করে ১৩ সিপাহীকে। এ ঘটনার ৭ দিনের মাথায় আইয়ুব বিতাড়িত হয়। মামলায় ৫ বিপ্লবীর ফাঁসি ও ১৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। মামলাটি বঙ্গবন্ধুর তদারকিতে হাইকোর্ট পর্যন্ত চলেছিল। হাইকোর্টে ফাঁসি মাপ করা হলেও সবার যাবজ্জীবন কারাদ- বহাল থাকে। এরপর করাচী ফেডারেল কোর্টে আপীল করার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। অতঃপর ৭২’র ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ওই সব বিপ্লবীদের কারাগার থেকে ছেড়ে দিতে তোফায়েল আহমেদকে নির্দেশ দিলে তদনুসারে ওই বিপ্লবীরা ছাড়া পায়। অথচ কুমিল্লার ওই বিপ্লবের কথা কেউ মনে রাখেনি। এখানকার মন্ত্রী, এমপি ও বড় বড় আমলা অনেকেই কুমিল্লার কথা ভাবে না। তাঁরা সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত।
কুমিল্লাবাসী ১৯৮৯ সালে কুমিল্লা বিভাগ ঘোষণা, ঢাকা-কুমিল্লা সরাসরি রেললাইন স্থাপনসহ ১৪ দফা দাবি নিয়ে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার অধিবাসীদের সমন্বয়ে গঠন করে কুমিল্লা গণফোরাম নামে একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের ব্যানারে কুমিল্লাবাসী রাজপথে নামলে ১৯৯২ সালে আপনি প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালীন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সফরের সময় মধ্য রাতে কুমিল্লা রেলস্টেশনে পৌঁছে এক বিশাল জনসমুদ্রে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ক্ষমতায় গেলে কুমিল্লা বিভাগ স্থাপনসহ সকল দাবি পূরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বেগম জিয়াও। ১৯৯৩ সালে আমরা কুমিল্লা গণফোরামের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে কুমিল্লার সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ ও জনতার সমন্বয়ে গঠন করি কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদ। সকল কুমিল্লাবাসী বিভাগের দাবিতে ঐ সময় রাজপথে নেমে মশাল মিছিল, হরতাল, অবরোধসহ বিশাল আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ শেষে ঢাকা গিয়ে কুমিল্লার সর্বস্তরের মানুষ ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে সারা দিন অনশন ধর্মঘট পালন করে। ওই সময় আমাদের দেখা দেখি সিলেটবাসী বিভাগ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নেমে পড়লে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া সিলেট বিভাগ ঘোষণা করেন। এতে কুমিল্লাবাসী মর্মাহত ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাত থেকে পরিত্যক্ত কুমিল্লা বিমানবন্দরের বিশাল এলাকা রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলনে নেমে পড়ি এবং সেখানে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। এতে সরকার বিমানবন্দর এলাকার কিছু অংশকে ইপিজেড ঘোষণা করলেও বিদেশীরা এখানে পূঁজি বিনিয়োগ করে আমাদের সব কিছু ব্যবহার করে উৎপাদিত সামগ্রী নিজ দেশে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। গত ২৫ বছরেও আমাদের বিভাগ ঘোষণার দাবি কোন সরকার কেন বাস্তবায়ন করেনি তা আজও অজানা। সব দিক দিয়ে কুমিল্লা রিক্ত, নিঃস্ব।
মাননীয় নেত্রী, আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসূরি। একদিন কুমিল্লাবাসী অভ্যুত্থান করে স্বৈরাচারী আইয়ুবকে হটিয়ে দিয়ে আপনার পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছিল। যেটা আজ বিলুপ্ত ইতিহাস। ওই সব বিপ্লবীর কথা কেউ এখন মনেও করে না। এতে আমাদের কোন দুঃখ নেই। ওই বিপ্লবীরা এবং আমরা সবাই চাই কুমিল্লার উন্নয়ন, ফিরে পেতে চাই কুমিল্লার হারানো ঐতিহ্য, সর্ব ব্যাপারে চট্টগ্রামে দৌড়াদৌড়ি করার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে চাই। নির্মাণাধীন চার লেন মহাসড়কে ঢাকা-কুমিল্লা অংশে রেললাইন সংযোগ দিলে শুধু কুমিল্লাবাসীর উপকার নয়, বরং পাল্টে যাবে গোটা দেশের যোগাযোগ চিত্র। এটা আমাদের দাবি জাতীয় স্বার্থে। তবে আমাদের আপাতত দাবি একটাই, অবিলম্বে কুমিল্লা বিভাগ ঘোষণা চাই।
আশা করি আপনি আমাদের এই প্রত্যাশা থেকে বঞ্চিত করবেন না।
সজিবুল হাসান সজিব
জার্মান থেকে।
Comments
Post a Comment