হস্তরেখা কাজী সজিব


হস্তরেখা
মোহাম্মদ ইসহাক খান

মন্টু বসে আছে জনাব হারুন দেওয়ান সাহেবের সামনে। তিনি একজন নামকরা হস্তরেখাবিদ। মন্টুকে এখানে নিয়ে এসেছে তার বন্ধু তপন। তপনের গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে অগাধ বিশ্বাস। তার বিশ্বাস, দেওয়ান সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী হাতে তিন রতি ওজনের হলুদ পাথরটা পড়ার পর থেকেই তার ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবাতাস লেগেছে, কোম্পানির শেয়ারের দাম তরতর করে উঠে গেছে। মন্টুর আগে কখনো এসবে বিশ্বাস ছিল না। তপন বলেছে, একবার ওনার কাছে হাতটা দেখিয়ে দেখ, তিনি তাকিয়ে থেকেই বলে দেবেন তোর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। মজা দেখার জন্যই এসেছে সে।
ডান হাত বাড়িয়ে দিল সে। আতশ কাচ ধরে ভুরু কুঁচকে দেওয়ান সাহেব হাতের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখতে লাগলেন। ক্রমে তাঁর কপালের ভাঁজ প্রশস্ত হল। মন্টুর দিকে তাকালেন তিনি।
আপনার আয়ুরেখায় তিন-তিনটা কাটা দেখা যাচ্ছে। অতি নিকট ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে পারেন। সাবধানে থাকবেন। জীবন মরণ সংশয়। আবারো বলি, জীবন মরণ সংশয়। দ্বিতীয়বারে কথাটা অনেক জোর দিয়ে বললেন, তাঁর শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠস্বর এই আলোআঁধারিতে আরো রহস্যময় শোনাল।
কবে নাগাদ বিপদ ঘটতে পারে? ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো সে।
বেশি না, এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহ। অনেক কথাই দেওয়ান সাহেব দুবার করে বলেন। সেজন্যেই হয়তো কথাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
দেওয়ান সাহেবের কথায় কিছু একটা ছিল, ভেতরটা সামান্য হলেও কেঁপে উঠলো মন্টুর। শুষ্ক হাসি হেসে বেরিয়ে এলো সে।
ব্যস্ত রাস্তা। প্রতিদিন এটা সে দু-চারবার পার হয়। মাথার ওপরে ওভারব্রিজ আছে, কিন্তু সেটা কখনো ব্যবহার করা হয় না। সময় কোথায়? ওঠানামা অনেক ঝামেলা মনে হয়। তার চেয়ে এক দৌড়ে পার হয়ে যাওয়া অনেক সহজ। একটু ঝুঁকি থাকে বৈকি।
কিন্তু আজ কেন যেন তার সাহসে কুলাল না। রাস্তার ধারে কয়েক মিনিট সে দাঁড়িয়ে রইলো, কয়েকবার মনকে সাহস দিল, মিছিমিছি ভয় পাচ্ছি। ভয়ের কিছু নেই। হাতের রেখায় কিছু লেখা থাকে না।
পা বাড়াল সে। কিন্তু ফিরে এলো পরক্ষনেই। কিছুতেই সাহস আসছে না। আজ প্রথম সে ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হল।
রাস্তার লোকগুলোকে আজ মনে হচ্ছে এক-একজন দুর্বৃত্ত, কখন সব লুট করে নেবে, সেই ধান্দায় আছে। পকেটে নগদ কিছু টাকা আছে, ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল একবার। বাসে উঠলো, কতক্ষণে নেমে যাবে সেই চিন্তায় রইলো। ড্রাইভার এত জোরে চালাচ্ছে কেন? বলেই উঠলো একবার। আস্তে চালান না, এত তাড়া কীসের?
যাত্রীরা তাকাল সবাই তার দিকে, আস্তে চালাবার কথা কখনো শোনা যায় না। সবার তাড়া আছে, সবাই জোরে চালাতে বলে।

বাসায় এসে গড়িয়ে পড়লো। উফ, সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। কিন্তু উঠে পড়লো পরক্ষনেই। সব দরজা জানালা ভাল করে দেখল, লাগানো হয়েছে কীনা। মনে মনে বলছে, না, হাতের রেখায় বিপদ লেখা থাকে না। কিন্তু সাবধান হতে ক্ষতি কি? অবচেতন মন যেন তাড়িয়ে ফিরছে তাকে, সারাদিন অস্থির হয়ে ছিল। একটা স্কুটার ভাড়া করেছিল কুড়িল যাওয়ার জন্য, ক্রমাগত ড্রাইভারকে বলে এসেছে আস্তে চালাবার জন্য, দুর্ঘটনা ঘটবে ভাই, আস্তে চালান। হাসে ড্রাইভার, গায়ে মাখে না। আরও আস্তে চালাইলে তো স্টার্ট বন্ধ হইয়া যাইব।
ঘরে শান্তি পাচ্ছে না মন্টু, বাইরে শান্তি পাচ্ছে না। জ্যোতিষী দেওয়ান সাহেবের কথায় জীবনটা কয়েকদিনে ওলটপালট হয়ে গেছে। তপনের সাথে যোগাযোগ নেই, ফোন বন্ধ পাচ্ছে। বিপদ আপদ ঘটলো না তো?
নানা চিন্তায় খাওয়াদাওয়া শিকেয় উঠে গেল মন্টুর, চোখের নিচে কালি পড়ে গেল, চুল উষ্কখুষ্ক, দুই চোখ জবাফুলের মতো লাল। বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিল। মনে মনে যেন বিপদের অপেক্ষা করছে সে। পাঁচদিনের দিন বেপরোয়া হয়ে উঠলো সে, বিপদ ঘটলে ঘটবে। কী আর হবে? বড়জোর মারা যাবো তো? তাতে কী হয়েছে? হা হা হা। পাগলের মতো হাসে মন্টু।
দুঃসহ আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা পার করলো সে, কিছুই ঘটলো না।
সেদিন দুপুরে সে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে, তখন ফোনটা বেজে উঠলো। তপন।
হ্যালো।
মন্টু, বাসায় আছিস? তোর সাথে একটু দেখা করতে চাই।
চলে আয়। কিছু হয়েছে নাকি?
সামনাসামনি বলবো, ফোন রেখে দেয় তপন।
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খায় মন্টু, ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে। কী ঘটেছে? বড় বড় নিঃশ্বাস নেয়, টেনশন কমাবার জন্য।

তপন দরজা খুলে ঢোকার পর প্রথম যে জিনিসটা খেয়াল করলো মন্টু, তা হল, তার ডান হাতের আঙুলে হলুদ রঙয়ের সেই পাথরটা নেই। তপনের চেহারার দিকে তাকানো যায় না, ঠিক মন্টুর মতোই অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে, ছাই দিয়ে কেউ তাকে মাখিয়ে দিয়েছে। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে তপন।
কী ব্যাপার?
আস্তে আস্তে সব খুলে বলে তপন, তার কোম্পানিতে এই সাতদিনে লালবাতি জ্বলে গেছে, শেয়ার সূচক কয়েকদিনে এমন নিচে নেমে গেছে যে কল্পনারও অতীত।
তোর আংটি?
দাঁত খিঁচিয়ে বলে তপন, বাথরুমের কমোডে ফেলে দিয়েছি। আমার বিশ্বাসই উঠে গেল। যেই আংটি শেয়ারের দাম ধরে রাখতে পারে না, সেটার ওখানেই জায়গা হওয়

Comments

Popular posts from this blog

কুমিল্লার কিছু আঞ্চলিক ভাষা :

চান্দিনা উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদ, চেয়ারম্যান সাহেব ও সচিবদের নাম এবং মোবাইল নাম্বার দেওয়া হইল।

অভিনেত্রী নিপুণ,কুমিল্লার মেয়ে।